গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন
গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন নিঃসন্দেহ দেশ ওজাতির জন্য উন্নয়নমূলক এক আধুনিক কার্যক্রম। কোন ঝামেলা ছাড়া অভিজ্ঞপশুচিকিৎসক দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের কাজ করাতে হবে। প্রতি উপজেলাতে পশুসম্পদউন্নয়নে সরকার একজন করে পশুচিকিৎসক নিয়োগ করেছেন। গরিব কৃষকসহ ওই এলাকারজনসাধরণ নানাবিধ পশু সমস্যার সমাধান পেয়ে থাকেন তাদের কাছ থেকে। এছাড়াবাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রথেকেও পশুপালন ও তার রোগবালাইয়ের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এককথায় কৃত্রিম প্রজননে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য উন্নত ষাঁড়ের শুক্রাণু ব্যবহার ওসুস্থ গাভীর প্রজনন অঙ্গে স্থাপন করতে পারলে বছরে বাচ্চা উৎপাদন দু'লক্ষেরওবেশি পাওয়া সম্ভব। বাকৃবি এ ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য পেয়েছে। মাঠ পর্যায়েব্যাপকহারে এ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে শিগগিরই ডেইরি শিল্প কাঙ্খিতস্বপ্নে পৌছাতে পারবে।
সাধারণত ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদ্ধতির মাধ্যমে গাভীরপ্রজনন অঙ্গে স্থাপন করাকে কৃত্রিম প্রজনন বলে। একটি ষাঁড়ের বীজ থেকেপ্রতি বছর ৬০ থেকে ৮০টি গাভীর প্রজনন করানো সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননেরমাধ্যমে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ গাভী প্রজনন করানো যায়। স্বাভাবিকভাবে একটিষাঁড়ের সর্বমোট ৭০০ থেকে ৯০০টি বাছুর প্রসবে ভূমিকা রাখতে পারে। কৃত্রিমপ্রজননের মাধ্যমে অনেকাংশে সংক্রামক ব্যাধি রোধ করা যায় এবং গাভী ষাঁড়েরদ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় না।
আমাদের দেশে ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন বা সংস্থাপনে অজ্ঞতারকারণে অনেক সময় গাভীর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। কৃত্রিম প্রজনন সুষ্ঠুভাবেপরিচালিত না হলে ভালর চেয়ে খারাপই হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। সংশ্লিষ্টব্যক্তিবর্গের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, অসাবধানতা, জ্ঞাত বাঅজ্ঞাতসারে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি-বিচ্যুতি এর জন্য দায়ী।
বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ষাঁড়ের অভাব থাকায় কৃত্রিম প্রজনন জরুরি হয়েপড়েছে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগতত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অসাবধানতা ও অনভিজ্ঞতার কারণেনানা সমস্যার সন্মুখিন হতে হয়। কৃত্রিম প্রজননের ভাল দিক যেমন আছে তেমনএর খারাপ দিকও কিছু আছে। বাস্তবে দেখা যায় স্বাভাবিক প্রজনন অপেক্ষাকৃত্রিম প্রজননে গর্ভ সঞ্চারের হার বেশ কম, বার বার গর্ভধারণ করাতে খরচওহয় বেশি। রোগাক্রান্ত ষাঁড়ের বীজ গাভীর প্রজনন অঙ্গে স্থাপন করা হলেপরবর্তীতে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যা। যার প্রভাব পরবর্তী বংশবিস্তারের উপরবর্তায়। এ ছাড়া অনেক গাভী বার বার গরম হয়ে থাকে। এক নিরীক্ষায় দেখাগেছে একটি গাভী গর্ভ সঞ্চারের জন্য গড়ে ১৩ বার পর্যন্ত প্রজননের প্রয়োজনহতে পারে।
রাসায়নিক দ্রব্য, ধূলিকণা, মাত্রারিক্ত তাপমাত্রার সংস্পর্শে খুব সহজেইষাঁড়ের বীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার যে সমস্ত জিনিস পত্রের সংস্পর্শেবীজ আসে তাতে রাসায়নিক পদার্থ থাকলেও বীজ নষ্ট হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেদেখা যায় বীজ তরল হলে কিংবা প্রজনন অঙ্গের বাইরে স্থাপন করা হলেও গাভীগর্ভধারণ করতে পারে না। ডিম্বাণু নির্গমনের আগে অথবা নির্গমনের পরে বীজস্থাপন করলে গাভীর উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই প্রথমবার বীজ স্থাপনের পর অন্তত৬ ঘন্টা পর দ্বিতীয়বার বীজ স্থাপন করলে সুফল পাওয়া যায় বেশি। বীজস্থাপনের সময় প্রজনন অঙ্গ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে গাভীর নানাবিধসমস্যা হতে পারে। যেমন ব্রুসেলেসিস, ভিব্রিওসিস, ট্রাইকোমনোসিসসহ বিভিন্নবংশগত রোগের সন্মুখিন হতে হয়। এ জন্য কোন সমস্যা দেখা দিলে পশুচিকিৎকেরপরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
সরকার প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যা পশুসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা করবে।
গাভী গর্ভবতী কিনা, নিয়মিত গরম হয় কিনা তা নির্ণয় করা, উন্নত ও উর্বরষাঁড় নির্বাচন করা, গাভীর গর্ভধারনের ক্ষমতা নির্ণয় করা, গর্ভধারনের হারবৃদ্ধি করা, গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং ভেটেরিনারিয়ানের সাহায্যেগাভীর নিয়মিত পরিচর্যা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তারদিয়ে করতে হবে।
কৃত্রিম প্রজননের জন্য ইতোমধ্যে খামারিদের সংগঠিত করা হয়েছে দেশের বিভিন্নজেলাতে। খামারিদের উৎপাদনমুখী সেবা ও প্রশিক্ষণ চলছে। অল্পদিনের মধ্যেইগরুর ব্যাপকহারে কৃত্রিম প্রজনন শুরু করা হবে বলে আশা করছে তারা। সমাজসেবাঅধিদপ্তরের মাধ্যমে দুটি সমিতি ইতোমধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছেকৃত্রিম প্রজননের সফলতা বাংলাদেশের প্রতি ঘরে ঘরে পৌছে যাবে এবং দুধউৎপাদনসহ গরুর সংখ্যা অধিকহারে বৃদ্ধি পাবে।
লেখক: মোঃ নূর আলী, পশু চিকিৎসক, ঝিনাইদহ
হিমায়িত বীজে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যতথা আমিষের চাহিদা পূরণে ও বেকারত্ব দূরীকরণে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলপালন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল দ্রুতবর্ধনশীল। এই জাতের ছাগল বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। ফলে ছাগলের প্রজননেরদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এরই ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিমপ্রজননে সফল হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু পালনঅনুষদের পশুবিজ্ঞানীরা।
একটি ছাগীকে প্রাকৃতিক নিয়মে পাঁঠা দ্বারা প্রজনন করালে একবারে যে পরিমাণবীজ ব্যবহৃত হয়, একই পরিমাণ বীজ দ্বারা হিমায়িত কৃত্রিম প্রজননপ্রযুক্তির সাহায্যে ২৫ থেকে ৩০ ছাগীকে প্রজনন করানো যায়। এ প্রযুক্তিব্যবহারে ফল পাওয়া যায় প্রাকৃতিক প্রজনন থেকে ২৫ থেকে ৩০ গুণ বেশি। এইহিমায়িত বীজ ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল রক্ষা করাসম্ভব বলে মনে করেন পশুবিজ্ঞানীরা।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার আশা করছেন, বিলুপ্তিপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এগবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া এ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায়এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও কাজে লাগানো যাবে। ইউএসডিএ’র অর্থায়নে একটিপ্রকল্পের মাধ্যমে ব্ল্যাক বেঙ্গলের কৃত্রিম প্রজননে গত দুই বছর ধরে গবেষণাচালিয়ে আসছে পশুপালন অনুষদের পশু প্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞান বিভাগ। বিভাগেরঅধ্যাপক ড. ইয়াহিয়া খন্দকার প্রকল্পটির পরিচালক এবং পশুপালন অনুষদেরসাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বিকল্প পরিচালক হিসেবে গবেষণাপরিচালনা করছেন। ব্ল্যাক বেঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা জাতের ছাগল হিসেবে অভিহিতকরা হলেও আন্তঃপ্রজনন ও অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কারণে ছাগলের এদেশি জাতটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এ উপলব্ধি থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গলেরসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাকৃবিতে কৃত্রিম প্রজননের এ প্রকল্পটিশুরু হয়।
গবেষক জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১৭টি সুস্থ-সবল পাঁঠা এবং শতাধিকছাগী সংগ্রহ করার মাধ্যমে শুরু হয় তাদের গবেষণা। গবেষণা ফিল্ডে সংগ্রহকৃতপাঁঠার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্নতজাতটি বাছাই করা হয়। বাছাইকৃতপাঁঠার বীজের গুণাগুণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। বীজপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলে তা হিমায়িত করে এআইগানের মাধ্যমে ছাগীকেকৃত্রিম প্রজনন করিয়ে উন্নতজাতের পাঁঠা উত্পাদন করা হয়। এভাবে প্রকল্পটিরমাধ্যমে দ্রুত ব্ল্যাক বেঙ্গলের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরওজানান, প্রাকৃতিক নিয়মে একটি পাঁঠার সঙ্গে একটি ছাগীর প্রজননের সময় ছাগীযে পরিমাণ বীজ গ্রহণ করে তার মাত্র কয়েক শতাংশ কাজে লাগে, বেশিরভাগই নষ্টহয়ে যায়। কিন্তু হিমায়িত বীজ দ্বারা কৃত্রিম প্রজননে ওই পরিমাণ বীজবেশক’টি ভাগে ভাগ করা হয়, যা ২০ থেকে ২৫টি ছাগী গ্রহণ করতে পারে। যার ফলেসমপরিমাণ বীজ দ্বারা ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি ফল পাওয়া যায়। এখন পর্যন্তগবেষণায় দেখা গেছে, এই হিমায়িত বীজের দ্বারা কৃত্রিম প্রজননে ছাগীরবাচ্চা ধারণ ক্ষমতা ৫০ শতাংশের বেশি, যা গাভীর বাচ্চা ধারণ ক্ষমতার প্রায়সমান। এসব হিমায়িত বীজকে তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রিসেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় এসব হিমায়িত বীজেরগুণাগুণ ৫০ বছর অটুট থাকবে, যা ভবিষ্যতে ছাগলের কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহারকরা যাবে। গবেষকরা আশা করছেন, বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের সংখ্যাদ্রুত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া এপ্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও কাজে লাগানো যাবে।
ভরণপোষণে অল্প খরচ, একসঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা, সাধারণরোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও দ্রুত বর্ধনশীল বলে এ জাতটি দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার হতে পারে। বিশেষ করে বাকৃবির বর্তমান এই গবেষণার ফলমাঠপর্যায়ে কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ পশু পুষ্টিরচাহিদা মেটানো ও বেকার সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া যাবে।প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পশুপালন গবেষক ওসংশ্লিষ্ট বিভাগকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেনবিশেষজ্ঞরা।
গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন
গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন নিঃসন্দেহ দেশ ওজাতির জন্য উন্নয়নমূলক এক আধুনিক কার্যক্রম। কোন ঝামেলা ছাড়া অভিজ্ঞপশুচিকিৎসক দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের কাজ করাতে হবে। প্রতি উপজেলাতে পশুসম্পদউন্নয়নে সরকার একজন করে পশুচিকিৎসক নিয়োগ করেছেন। গরিব কৃষকসহ ওই এলাকারজনসাধরণ নানাবিধ পশু সমস্যার সমাধান পেয়ে থাকেন তাদের কাছ থেকে। এছাড়াবাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রথেকেও পশুপালন ও তার রোগবালাইয়ের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এককথায় কৃত্রিম প্রজননে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য উন্নত ষাঁড়ের শুক্রাণু ব্যবহার ওসুস্থ গাভীর প্রজনন অঙ্গে স্থাপন করতে পারলে বছরে বাচ্চা উৎপাদন দু'লক্ষেরওবেশি পাওয়া সম্ভব। বাকৃবি এ ক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য পেয়েছে। মাঠ পর্যায়েব্যাপকহারে এ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলে শিগগিরই ডেইরি শিল্প কাঙ্খিতস্বপ্নে পৌছাতে পারবে।
সাধারণত ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদ্ধতির মাধ্যমে গাভীরপ্রজনন অঙ্গে স্থাপন করাকে কৃত্রিম প্রজনন বলে। একটি ষাঁড়ের বীজ থেকেপ্রতি বছর ৬০ থেকে ৮০টি গাভীর প্রজনন করানো সম্ভব। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননেরমাধ্যমে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ গাভী প্রজনন করানো যায়। স্বাভাবিকভাবে একটিষাঁড়ের সর্বমোট ৭০০ থেকে ৯০০টি বাছুর প্রসবে ভূমিকা রাখতে পারে। কৃত্রিমপ্রজননের মাধ্যমে অনেকাংশে সংক্রামক ব্যাধি রোধ করা যায় এবং গাভী ষাঁড়েরদ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় না।
আমাদের দেশে ষাঁড়ের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন বা সংস্থাপনে অজ্ঞতারকারণে অনেক সময় গাভীর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। কৃত্রিম প্রজনন সুষ্ঠুভাবেপরিচালিত না হলে ভালর চেয়ে খারাপই হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। সংশ্লিষ্টব্যক্তিবর্গের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, অসাবধানতা, জ্ঞাত বাঅজ্ঞাতসারে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি-বিচ্যুতি এর জন্য দায়ী।
বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে ষাঁড়ের অভাব থাকায় কৃত্রিম প্রজনন জরুরি হয়েপড়েছে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগতত্রুটি-বিচ্যুতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অসাবধানতা ও অনভিজ্ঞতার কারণেনানা সমস্যার সন্মুখিন হতে হয়। কৃত্রিম প্রজননের ভাল দিক যেমন আছে তেমনএর খারাপ দিকও কিছু আছে। বাস্তবে দেখা যায় স্বাভাবিক প্রজনন অপেক্ষাকৃত্রিম প্রজননে গর্ভ সঞ্চারের হার বেশ কম, বার বার গর্ভধারণ করাতে খরচওহয় বেশি। রোগাক্রান্ত ষাঁড়ের বীজ গাভীর প্রজনন অঙ্গে স্থাপন করা হলেপরবর্তীতে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যা। যার প্রভাব পরবর্তী বংশবিস্তারের উপরবর্তায়। এ ছাড়া অনেক গাভী বার বার গরম হয়ে থাকে। এক নিরীক্ষায় দেখাগেছে একটি গাভী গর্ভ সঞ্চারের জন্য গড়ে ১৩ বার পর্যন্ত প্রজননের প্রয়োজনহতে পারে।
রাসায়নিক দ্রব্য, ধূলিকণা, মাত্রারিক্ত তাপমাত্রার সংস্পর্শে খুব সহজেইষাঁড়ের বীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার যে সমস্ত জিনিস পত্রের সংস্পর্শেবীজ আসে তাতে রাসায়নিক পদার্থ থাকলেও বীজ নষ্ট হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেদেখা যায় বীজ তরল হলে কিংবা প্রজনন অঙ্গের বাইরে স্থাপন করা হলেও গাভীগর্ভধারণ করতে পারে না। ডিম্বাণু নির্গমনের আগে অথবা নির্গমনের পরে বীজস্থাপন করলে গাভীর উর্বরতা হ্রাস পায়। তাই প্রথমবার বীজ স্থাপনের পর অন্তত৬ ঘন্টা পর দ্বিতীয়বার বীজ স্থাপন করলে সুফল পাওয়া যায় বেশি। বীজস্থাপনের সময় প্রজনন অঙ্গ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে গাভীর নানাবিধসমস্যা হতে পারে। যেমন ব্রুসেলেসিস, ভিব্রিওসিস, ট্রাইকোমনোসিসসহ বিভিন্নবংশগত রোগের সন্মুখিন হতে হয়। এ জন্য কোন সমস্যা দেখা দিলে পশুচিকিৎকেরপরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
সরকার প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যা পশুসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা করবে।
গাভী গর্ভবতী কিনা, নিয়মিত গরম হয় কিনা তা নির্ণয় করা, উন্নত ও উর্বরষাঁড় নির্বাচন করা, গাভীর গর্ভধারনের ক্ষমতা নির্ণয় করা, গর্ভধারনের হারবৃদ্ধি করা, গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং ভেটেরিনারিয়ানের সাহায্যেগাভীর নিয়মিত পরিচর্যা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তারদিয়ে করতে হবে।
কৃত্রিম প্রজননের জন্য ইতোমধ্যে খামারিদের সংগঠিত করা হয়েছে দেশের বিভিন্নজেলাতে। খামারিদের উৎপাদনমুখী সেবা ও প্রশিক্ষণ চলছে। অল্পদিনের মধ্যেইগরুর ব্যাপকহারে কৃত্রিম প্রজনন শুরু করা হবে বলে আশা করছে তারা। সমাজসেবাঅধিদপ্তরের মাধ্যমে দুটি সমিতি ইতোমধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে। আশা করা যাচ্ছেকৃত্রিম প্রজননের সফলতা বাংলাদেশের প্রতি ঘরে ঘরে পৌছে যাবে এবং দুধউৎপাদনসহ গরুর সংখ্যা অধিকহারে বৃদ্ধি পাবে।
লেখক: মোঃ নূর আলী, পশু চিকিৎসক, ঝিনাইদহ
হিমায়িত বীজে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যতথা আমিষের চাহিদা পূরণে ও বেকারত্ব দূরীকরণে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলপালন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল দ্রুতবর্ধনশীল। এই জাতের ছাগল বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। ফলে ছাগলের প্রজননেরদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এরই ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কৃত্রিমপ্রজননে সফল হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু পালনঅনুষদের পশুবিজ্ঞানীরা।
একটি ছাগীকে প্রাকৃতিক নিয়মে পাঁঠা দ্বারা প্রজনন করালে একবারে যে পরিমাণবীজ ব্যবহৃত হয়, একই পরিমাণ বীজ দ্বারা হিমায়িত কৃত্রিম প্রজননপ্রযুক্তির সাহায্যে ২৫ থেকে ৩০ ছাগীকে প্রজনন করানো যায়। এ প্রযুক্তিব্যবহারে ফল পাওয়া যায় প্রাকৃতিক প্রজনন থেকে ২৫ থেকে ৩০ গুণ বেশি। এইহিমায়িত বীজ ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল রক্ষা করাসম্ভব বলে মনে করেন পশুবিজ্ঞানীরা।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার আশা করছেন, বিলুপ্তিপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এগবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া এ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায়এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও কাজে লাগানো যাবে। ইউএসডিএ’র অর্থায়নে একটিপ্রকল্পের মাধ্যমে ব্ল্যাক বেঙ্গলের কৃত্রিম প্রজননে গত দুই বছর ধরে গবেষণাচালিয়ে আসছে পশুপালন অনুষদের পশু প্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞান বিভাগ। বিভাগেরঅধ্যাপক ড. ইয়াহিয়া খন্দকার প্রকল্পটির পরিচালক এবং পশুপালন অনুষদেরসাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন বিকল্প পরিচালক হিসেবে গবেষণাপরিচালনা করছেন। ব্ল্যাক বেঙ্গলকে পৃথিবীর সেরা জাতের ছাগল হিসেবে অভিহিতকরা হলেও আন্তঃপ্রজনন ও অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কারণে ছাগলের এদেশি জাতটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এ উপলব্ধি থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গলেরসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাকৃবিতে কৃত্রিম প্রজননের এ প্রকল্পটিশুরু হয়।
গবেষক জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১৭টি সুস্থ-সবল পাঁঠা এবং শতাধিকছাগী সংগ্রহ করার মাধ্যমে শুরু হয় তাদের গবেষণা। গবেষণা ফিল্ডে সংগ্রহকৃতপাঁঠার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্নতজাতটি বাছাই করা হয়। বাছাইকৃতপাঁঠার বীজের গুণাগুণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। বীজপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলে তা হিমায়িত করে এআইগানের মাধ্যমে ছাগীকেকৃত্রিম প্রজনন করিয়ে উন্নতজাতের পাঁঠা উত্পাদন করা হয়। এভাবে প্রকল্পটিরমাধ্যমে দ্রুত ব্ল্যাক বেঙ্গলের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরওজানান, প্রাকৃতিক নিয়মে একটি পাঁঠার সঙ্গে একটি ছাগীর প্রজননের সময় ছাগীযে পরিমাণ বীজ গ্রহণ করে তার মাত্র কয়েক শতাংশ কাজে লাগে, বেশিরভাগই নষ্টহয়ে যায়। কিন্তু হিমায়িত বীজ দ্বারা কৃত্রিম প্রজননে ওই পরিমাণ বীজবেশক’টি ভাগে ভাগ করা হয়, যা ২০ থেকে ২৫টি ছাগী গ্রহণ করতে পারে। যার ফলেসমপরিমাণ বীজ দ্বারা ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি ফল পাওয়া যায়। এখন পর্যন্তগবেষণায় দেখা গেছে, এই হিমায়িত বীজের দ্বারা কৃত্রিম প্রজননে ছাগীরবাচ্চা ধারণ ক্ষমতা ৫০ শতাংশের বেশি, যা গাভীর বাচ্চা ধারণ ক্ষমতার প্রায়সমান। এসব হিমায়িত বীজকে তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রিসেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় এসব হিমায়িত বীজেরগুণাগুণ ৫০ বছর অটুট থাকবে, যা ভবিষ্যতে ছাগলের কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহারকরা যাবে। গবেষকরা আশা করছেন, বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের সংখ্যাদ্রুত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া এপ্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় এটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও কাজে লাগানো যাবে।
ভরণপোষণে অল্প খরচ, একসঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা, সাধারণরোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ও দ্রুত বর্ধনশীল বলে এ জাতটি দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের হাতিয়ার হতে পারে। বিশেষ করে বাকৃবির বর্তমান এই গবেষণার ফলমাঠপর্যায়ে কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচনসহ পশু পুষ্টিরচাহিদা মেটানো ও বেকার সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া যাবে।প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করে মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে পশুপালন গবেষক ওসংশ্লিষ্ট বিভাগকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেনবিশেষজ্ঞরা।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস